বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৭ জেলার ৪৮টি উপজেলায় হাওড়গুলি অবস্থিত। হাওড়গুলি বর্ষাকালে পানিতে টুইটুম্বর থাকে। হাওড়ের গ্রাম গুলি পানিতে ভাসমান দ্বীপের মত দেখায়। কাকতালীয়ভাবে হাওড় বলতে কেবল সিলেট জেলার নামটি বেশী উচ্চারিত হয়ে থাকে। সচরাচর সিলেট বেসিনকেই হাওড় মনে করা হয়। হাওড়ে অঞ্চলে ধান, মাছ সহ প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাপ্যতার কারনে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রচুর মানুষ হাওড় এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল। তবে এখন আর সেই আগের অবস্থা নেই।
সুনামগঞ্জ জেলায়
সর্ব্বোচ্চ ১৩৩টি হাওড় অবস্থিত ।
২০২৩ সালের ২৬শে আগষ্ট সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার উপজেলা পরিষদ মিলনায়তন এ একশনএইড বাংলাদেশ এর উদ্যোগে হাওড় অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা বা সংকট সমুহ এবং তা মোকাবিলায় করনীয় নিয়ে একটি কর্মশালা আয়োজন করা হয়। কর্মশালাটি আয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল হাওড় ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থা। উক্ত কর্মশালায় উপস্থিত সুধীজন বেশকিছু সংকট ও সমাধানের উপায় চিহ্নিত করেন।
হাওড় অঞ্চলের রাস্তাঘাটসহ
অবকাটামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে অনেক। তবে প্রায় প্রতি বছর হাওড়ের মানুষকে নানাধরনের
প্রাকৃতিক দুযোগ এর সাথে লড়াই করতে হয়।
কর্মশালায় বেশকিছু সংকট ও সমাধানে করনীয় সুপারিশ করা হয়।
1. Aspects of marginalization
- সীমান্ত এলাকায় বালুপাথর উত্তোলনের সুযোগ থাকলে মানুষ বাড়তি আয়ের সুযোগ
পায়। কিন্তু ড্রেজার, বোমা মেশিন ইত্যাদি ব্যবহার করে বালু পাথর উত্তোলন করায় শ্রমিকরা সেই সুযোগ
থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এদের আয় রোজগার কমে গেছে।
- চারদিকে থৈ থৈ পানি থাকার কারণে যাতায়াতের সমস্যা হচ্ছে।
- জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হাওর অঞ্চলে ঘন ঘন অকাল বন্যা হচ্ছে। এতে এক ফসলী
জমিগুলোর ফসল হানি ঘটছে।
- অকাল বন্যা ছাড়াও মৌসুমী বন্যায় হাওরে মাঝে মাঝে বাড়ি ঘর নষ্ট হচ্ছে। ফসল
নষ্ট হচ্ছে। দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
- আফাল (বড় ঢেউ) এর কারনে বাড়িঘর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
- ঢেউয়ে গ্রামের এবং বাড়ির ভিটেমাটি ক্ষয় হচ্ছে।
- খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে আশা বালি বন্যায় রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, পুকুর, প্রতিষ্ঠান তলিয়ে যাচ্ছে।
- পাহাড়ি ঢল ও বালি বন্যায় রাস্তাঘাট ভেঙ্গে বিধ্বস্ত হচ্ছে এতে যাতায়াত
ব্যবস্থায় মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে।
2. Type of
vulnerability- (বিপদাপন্নতার ধরণ/প্রকারভেদ)
- চারদিকে থৈ থৈ পানি থাকার কারণে ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া কঠিন
হয়ে উঠেছে। হাওর পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় অনেক নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে।
এতে কিছু ছাত্রছাত্রীর সলিল সমাধিও হয়েছে।
- নৌকা ভাড়া করে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়। আসা-যাওয়ার
খরচ বেশি হওয়ার কারণে অনেক ছাত্র-ছাত্রী বিদ্যালয়ে নিয়মিত যেতে পারে না।
- ছাত্র-ছাত্রীদের মতো শিক্ষকরা ও নিয়ম করে বিদ্যালয়ে যেতে পারেন না এতে
শিক্ষার মান ভালো হচ্ছে না।
- ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোর জন্য প্রাইভেট টিউটর পাওয়া যায় না।
- যাতায়াত সমস্যার কারণে রোগীদের হাসপাতালে যেতে সমস্যা হয়। এতে বিশেষত
গর্ভবতী মায়েরা সমস্যায় পড়েন।
- হাওর ও নদীর অপরিচ্ছন্ন পানি ব্যবহারের কারণে অনেকেই চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়।
- প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়া এবং অর্থনৈতিক
সংকটের কারণে অনেকেই এই এলাকার ছেড়ে শহরে বা অন্য কোন এলাকায় স্থানান্তরিত
হচ্ছে।
- যাতায়াত দুর্গম হওয়ার কারণে প্রশাসনিক ইউনিট (থানা ও উপজেলা) এর সঠিক সেবা
নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
- পর্যাপ্ত পরিমান টিউবওয়েল না থাকার কারণে সুপেয় পানির সমস্যা দেখা দেয়।
- বাধ্য হয়ে অনেক পরিবারকে হাওরের ও নদীর পানি পান করতে হচ্ছে।
- মানসম্মত পয়ো নিষ্কাশনের ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় অনেককে খোলা পায়খানা
ব্যবহার করতে হচ্ছে।
- পাহাড়ি ঢলে বালি আসার কারণে মানসম্মত পায়খানা গুলো সহজেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
তাই অস্থায়ীভাবে খোলা লেট্রিন ব্যবহার করছে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত গ্রামগুলো।
- যাতায়াত ব্যবস্থা দুর্গম হওয়ার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঠিক নজরদারি রাখা
কঠিন হয়ে যায়। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটে।
- দুর্গম এলাকা হয় কর্মকর্তা, চিকিৎসকরা হাওর এলাকায় অবস্থান করতে চান না। এতে অনেক পোস্ট খালি থাকে এবং
সেবার মান কম থাকে।
- রাজনৈতিক নেতারাও পরিবার নিয়ে শহরে অবস্থান করেন। এতে এলাকার সমস্যা সাথে
সাথে নিরসন করা বা এলাকায় অবস্থান করে প্রকৃত পরিস্থিতি যাচাই করার ক্ষেত্রে
সমস্যার সৃষ্টি হয়।
- অভিভাবকদের অসচেতনতা ও অর্থনৈতিক কারণে বাল্যবিবাহ বেশি হচ্ছে।
- শিক্ষা কম থাকা ও অসচেতনতার কারণে অনেকেই অধিকার সম্পর্কে সচেতন নন। এতে তারা
অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
- বছরের ছয় মাস পানিবেষ্টিত থাকার কারণে সব সময় কাজের সুযোগ থাকে না। ছদ্ম
বেকারত্ব দেখা দেয়।
- আগে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে অকালবন্যা হতো। এখন মার্চ মাসের শেষ দিকেও অকাল
বন্যা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই সাইকেল পরিবর্তন হচ্ছে।
3. Coping
mechanism (বিপদাপন্নতা
মোকাবিলার পদ্ধতি ও সুনির্দষ্ট দাবীসমূহ)
- বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের অনেকে খাটের উপর বা ঘরে মাচা বানিয়ে
দিনাতিপাত করেছে। কেউ কেউ গাছে উঠে জীবন রক্ষা করেছে।
- সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণের চিড়া মুড়ি, খিচুড়ি বা চাল, ডাল খেয়ে পরিস্থিতি
মোকাবেলা করেছে।
- সব এলাকায় ত্রাণ পৌঁছে নি। যখন খাবারের অভাব থাকে তখন মানুষ কম খেয়ে দিন
যাপন করে।
- সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে কিছু ঘরবাড়ি মেরামত ও পূণ:নির্মাণ করা হয়েছে। এর
পাশাপাশি ভুক্তভোগী মানুষ নিজেরাও ঘর মেরামত করেছেন।
- এনজিও থেকে বা গ্রাম্য মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়।
- অনেক মানুষ নিজের পিতৃপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে।
পরামর্শ:
- হাওর এলাকার নদী ও বিলগুলো বিজ্ঞান সম্মত ভাবে খনন করতে হবে।
- গ্রামগুলোতে সরকারিভাবে বা বেসরকারি উদ্যোগে গ্রাম প্রতিরক্ষা দেয়াল তৈরি
করতে হবে।
- হাওর এলাকায় বেশি করে হিজল, করচ সহ স্থানীয় জাতের গাছ রোপণ করা দরকার।
- হাওর রক্ষা বাঁধ নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী
বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
- ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের জন্য সরকারিভাবে বড় ধরনের
নৌকার ব্যবস্থা করতে হবে।
- হাওরের দুর্গমতা বিবেচনায় নিয়ে প্রত্যেকটি গ্রামে একটি করে প্রাথমিক
বিদ্যালয় নির্মাণ করতে হবে।
- হাওর এলাকায় কর্মরত প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকদের হাওর ভাতা প্রদান
করতে হবে।
- নৌকায় করে স্কুল (শিক্ষা তরী) কার্যক্রম ভালো ফল দিতে পারে।
- মাছের উৎপাদন বাড়াতে হাওরের মৎস্য অভয়াশ্রম গুলো কার্যকর ভাবে বাস্তবায়ন
করতে হবে। প্রত্যেক হাওরে মৎস্য অভয়াশ্রম থাকতে হবে।
- বিল সেচ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করতে হবে।
- কোনা জাল , কারেন্ট জাল সহ সকল অবৈধ জাল দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করতে সরকারকে কার্যকরী ভূমিকা
পালন করতে হবে।
- প্রজনন কালীন সময়ে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে এবং এই সময়ে জেলেদের প্রণোদনা
দিতে হবে।
- প্রত্যেক বছর হাওরে পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছের পোনা অবমুক্ত করতে হবে।
- হাওরের কৃষক ও জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
যেমন-খাঁচায় মাছ চাষ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, গবাদি পশু, হাঁস পালন ইত্যাদি।
- জেলেদের ভাসান পানিতে মাছ ধরার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
- জলমহাল নীতিমালা ২০০৯ এর আলোকে যাতে প্রকৃত মৎস্যজীবীরা বিল ডি লিজ আনতে পারে
সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
- প্রত্যেকটি বিলের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে।
- হাওরের জন্য স্বল্প জীবনের উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান আবিষ্কার করে তার ব্যবহার
নিশ্চিত করা।
- ভারতের সীমান্ত এলাকায় উন্মুক্ত ভাবে কয়লা উত্তোলন বন্ধ করতে হবে।
- বালি বন্যায় যেসব স্থান ইতিমধ্যে ভরাট হয়ে গেছে সেসব স্থান থেকে বালু পাথর
উত্তোলন করে প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে।
- যাতায়াত ব্যবস্থা ও দুর্গমতা বিবেচনা করে হাওর অঞ্চলে আরো ঘন ঘন প্রশাসনিক
ইউনিট (উপজেলা, থানা) গঠন করতে হবে।
- হাওর অঞ্চলে আরো ঘন ঘন কমিউনিটি ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নির্মাণ
করতে হবে।
- সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে হাওরের গ্রামগুলোতে মানসম্মত লেট্রিন ও টিউবওয়েল
প্রদান করতে হবে।