Sunday, July 6, 2025

হবিগঞ্জ জেলার নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র সমুহ

 প্রকৃতি ও ইতিহাসের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে হবিগঞ্জ জেলায়। হাওর-বাঁওড়, চা বাগান, ঐতিহাসিক স্থাপনা আর সমৃদ্ধ বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য নিয়ে এই জেলা পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। হবিগঞ্জের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রগুলোর বিস্তারিত বিবরণ ও ভ্রমণ নির্দেশিকা নিচে তুলে ধরা হলো।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান:

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এক সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক বিস্ময়। ২৪৩ হেক্টর আয়তনের এই উদ্যানে রয়েছে সাতটি পাহাড়ি ছড়া, যেখান থেকে এর নামকরণ হয়েছে 'সাতছড়ি'। এটি মূলত একটি ক্রান্তীয় চিরসবুজ ও মিশ্র-চিরহরিৎ বন।

কী দেখবেন: ঘন সবুজ অরণ্য, বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী যেমন - উল্লুক, চশমা পরা হনুমান, মেছোবাঘ, কয়েক প্রজাতির সাপ ও প্রায় ১৯৭ প্রজাতির পাখি। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ও বাঁশবন। ট্রেকিংয়ের জন্য উদ্যানে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও তিন ঘণ্টার তিনটি ট্রেইল রয়েছে। বনের গভীরে টিপরা নৃ-গোষ্ঠীর আদিবাসীদের জীবনযাত্রাও দেখার সুযোগ মিলবে।

কখন যাবেন: বছরের যেকোনো সময়ই সাতছড়ি ভ্রমণ করা যায়, তবে বর্ষায় এর সবুজ রূপ আরো স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। শীতকালে ট্রেকিংয়ের জন্য আবহাওয়া অনুকূলে থাকে।

কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সিলেটগামী যেকোনো বাসে চড়ে শায়েস্তাগঞ্জ নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি বা অটোরিকশাযোগে সরাসরি সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে পৌঁছানো যায়। হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকেও একইভাবে যাওয়া যায়।

অন্যান্য তথ্য: উদ্যানের প্রবেশপথে বন বিভাগের একটি চমৎকার বিশ্রামাগার রয়েছে এবং পর্যটকদের জন্য নামমাত্র প্রবেশমূল্য রয়েছে। সঙ্গে একজন ইকো-গাইড নিলে বন ভ্রমণ আরো সহজ ও আনন্দদায়ক হবে।

রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য:

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনভূমি হিসেবে পরিচিত রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত সংলগ্ন। প্রায় ১৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এই বনে রয়েছে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমাহার।

কী দেখবেন: এই অভয়ারণ্যে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি এবং ৬০০-এর বেশি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এখানে দেখা মিলতে পারে বিরল প্রজাতির মালায়ান বড় কাঠবিড়ালি, উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমান এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখির। বনের ভেতরে রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এছাড়াও এখানে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা এবং তিন ঘণ্টার তিনটি আলাদা ট্রেইল রয়েছে।

কখন যাবেন: শীতকাল রেমা-কালেঙ্গা ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী সময়। বর্ষায় যাতায়াত কিছুটা কষ্টসাধ্য হতে পারে।

কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে শায়েস্তাগঞ্জ অথবা শ্রীমঙ্গল এসে সেখান থেকে সিএনজি বা জিপ ভাড়া করে রেমা-কালেঙ্গা যাওয়া যায়। হবিগঞ্জ শহর থেকে চুনারুঘাট হয়েও এখানে পৌঁছানো সম্ভব।

থাকা-খাওয়া: বনের ভেতরে বন বিভাগের বিশ্রামাগারে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, তবে এর জন্য পূর্বানুমতির প্রয়োজন। এছাড়া শ্রীমঙ্গল বা হবিগঞ্জ শহরে রাত্রিযাপন করা যেতে পারে।


হবিগঞ্জের চা বাগান:
বৈকন্ঠপুর চা বাগান

হবিগঞ্জের বাহুবল, নবীগঞ্জ ও চুনারুঘাট উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য চা বাগান। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ চা বাগানগুলোর মনোরম দৃশ্য যেকোনো ভ্রমণকারীকে মুগ্ধ করবে।

কী দেখবেন: বাহুবল উপজেলার বৃন্দাবন চা বাগান, নবীগঞ্জের ইমাম ও বাওয়ানী চা বাগান এবং চুনারুঘাটের চান্দপুর চা বাগান উল্লেখযোগ্য। চা গাছ থেকে পাতা তোলার দৃশ্য, চা প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়।

কীভাবে যাবেন: হবিগঞ্জ শহর থেকে লোকাল বাস বা সিএনজিযোগে সহজেই এই চা বাগানগুলোতে পৌঁছানো যায়।

ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পীঠস্থান

 বিতঙ্গল আখড়া:

হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় অবস্থিত বিতঙ্গল আখড়া বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক পবিত্র তীর্থস্থান। হাওরের মধ্যবর্তী এক মনোরম পরিবেশে ষোড়শ শতকে রামকৃষ্ণ গোস্বামী এটি প্রতিষ্ঠা করেন।

কী দেখবেন: মধ্যযুগীয় স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত এই আখড়ায় ১২০ জন বৈষ্ণবের থাকার জন্য ১২০টি কক্ষ রয়েছে। এখানকার ২৫ মণ ওজনের শ্বেতপাথরের চৌকি, পিতলের সিংহাসন ও প্রাচীন রথ পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে।

কখন যাবেন: বর্ষাকালে হাওরের পানিতে যখন চারপাশ থৈ থৈ করে, তখন নৌকায় করে আখড়ায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা এককথায় অসাধারণ। তবে বছরের যেকোনো সময়ই যাওয়া যায়।

কীভাবে যাবেন: হবিগঞ্জ শহর থেকে বানিয়াচং গিয়ে সেখান থেকে বর্ষাকালে নৌকা এবং শুকনা মৌসুমে জিপ বা মোটরসাইকেলে সুজাতপুর গিয়ে সেখান থেকে নৌকায় বা পায়ে হেঁটে আখড়ায় পৌঁছাতে হয়।

 শংকরপাশা শাহী মসজিদ:

হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত শংকরপাশা শাহী মসজিদটি সুলতানি আমলের এক অনন্য স্থাপত্যকীর্তি। ১৪৯৩ সালে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে এটি নির্মিত হয়।

কী দেখবেন: পোড়ামাটির ফলক ও অসাধারণ কারুকার্যখচিত এই মসজিদে চারটি গম্বুজ রয়েছে। এর স্থাপত্যশৈলী তৎকালীন মুসলিম ঐতিহ্যের পরিচায়ক।

কীভাবে যাবেন: হবিগঞ্জ শহর থেকে অটোরিকশা বা সিএনজিযোগে সহজেই এই ঐতিহাসিক মসজিদে পৌঁছানো যায়।

আধুনিক বিনোদন ও অবকাশ যাপন

দ্যা প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট:

যারা প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে বিলাসবহুল পরিবেশে অবকাশ যাপন করতে চান, তাদের জন্য বাহুবল উপজেলায় অবস্থিত "দ্যা প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট" একটি আদর্শ জায়গা। প্রায় ১৫০ একর জায়গা জুড়ে পাহাড় ও সবুজের সমারোহে এই রিসোর্টটি নির্মিত।

বৈশিষ্ট্য: এখানে রয়েছে আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধাসহ ভিলা ও হোটেল কক্ষ, একাধিক রেস্তোরাঁ, সুইমিং পুল, সিনেপ্লেক্স এবং বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার ব্যবস্থা।

প্রবেশ: এখানে থাকতে বা ঘুরতে হলে আগে থেকে বুকিং করা আবশ্যক।

ভ্রমণ নির্দেশিকা

যাতায়াত: ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে সহজেই হবিগঞ্জ যাওয়া যায়। ঢাকার সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে হবিগঞ্জগামী বিভিন্ন বাস চলাচল করে। ট্রেনে যেতে চাইলে শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে নামতে হবে।

থাকা-খাওয়া: হবিগঞ্জ শহরে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। এছাড়া সাতছড়ি ও রেমা-কালেঙ্গার কাছে সরকারি বন বিশ্রামাগার এবং বাহুবলে বিলাসবহুল রিসোর্ট রয়েছে। হবিগঞ্জের স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে শহরের রেস্তোরাঁগুলোতে ঢুঁ মারতে পারেন।

পরামর্শ:

o প্রাকৃতিক বনে ভ্রমণের সময় আরামদায়ক পোশাক ও জুতা পরুন।

o মশা তাড়ানোর স্প্রে ও প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম সঙ্গে রাখুন।

o পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন।

o স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন।

হবিগঞ্জের এই পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভ্রমণপিপাসুদের জন্য নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা বয়ে আনবে। তাই সুযোগ  পেলে ঘুরে আসুন প্রকৃতি ও ইতিহাসের এই অপূর্ব মিলনস্থল থেকে।

https://tiplolasker.blogspot.com/2017/08/blog-post_6.html