Sunday, July 6, 2025

হবিগঞ্জ জেলার নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র সমুহ

 প্রকৃতি ও ইতিহাসের এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে হবিগঞ্জ জেলায়। হাওর-বাঁওড়, চা বাগান, ঐতিহাসিক স্থাপনা আর সমৃদ্ধ বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য নিয়ে এই জেলা পর্যটকদের জন্য এক আকর্ষণীয় গন্তব্য। হবিগঞ্জের বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রগুলোর বিস্তারিত বিবরণ ও ভ্রমণ নির্দেশিকা নিচে তুলে ধরা হলো।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান:

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান এক সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক বিস্ময়। ২৪৩ হেক্টর আয়তনের এই উদ্যানে রয়েছে সাতটি পাহাড়ি ছড়া, যেখান থেকে এর নামকরণ হয়েছে 'সাতছড়ি'। এটি মূলত একটি ক্রান্তীয় চিরসবুজ ও মিশ্র-চিরহরিৎ বন।

কী দেখবেন: ঘন সবুজ অরণ্য, বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী যেমন - উল্লুক, চশমা পরা হনুমান, মেছোবাঘ, কয়েক প্রজাতির সাপ ও প্রায় ১৯৭ প্রজাতির পাখি। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ও বাঁশবন। ট্রেকিংয়ের জন্য উদ্যানে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ও তিন ঘণ্টার তিনটি ট্রেইল রয়েছে। বনের গভীরে টিপরা নৃ-গোষ্ঠীর আদিবাসীদের জীবনযাত্রাও দেখার সুযোগ মিলবে।

কখন যাবেন: বছরের যেকোনো সময়ই সাতছড়ি ভ্রমণ করা যায়, তবে বর্ষায় এর সবুজ রূপ আরো স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে। শীতকালে ট্রেকিংয়ের জন্য আবহাওয়া অনুকূলে থাকে।

কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সিলেটগামী যেকোনো বাসে চড়ে শায়েস্তাগঞ্জ নামতে হবে। সেখান থেকে সিএনজি বা অটোরিকশাযোগে সরাসরি সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে পৌঁছানো যায়। হবিগঞ্জ জেলা শহর থেকেও একইভাবে যাওয়া যায়।

অন্যান্য তথ্য: উদ্যানের প্রবেশপথে বন বিভাগের একটি চমৎকার বিশ্রামাগার রয়েছে এবং পর্যটকদের জন্য নামমাত্র প্রবেশমূল্য রয়েছে। সঙ্গে একজন ইকো-গাইড নিলে বন ভ্রমণ আরো সহজ ও আনন্দদায়ক হবে।

রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য:

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক বনভূমি হিসেবে পরিচিত রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য চুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত সংলগ্ন। প্রায় ১৭৯৫ হেক্টর আয়তনের এই বনে রয়েছে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমাহার।

কী দেখবেন: এই অভয়ারণ্যে ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৬৭ প্রজাতির পাখি এবং ৬০০-এর বেশি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এখানে দেখা মিলতে পারে বিরল প্রজাতির মালায়ান বড় কাঠবিড়ালি, উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমান এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখির। বনের ভেতরে রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। এছাড়াও এখানে আধা ঘণ্টা, এক ঘণ্টা এবং তিন ঘণ্টার তিনটি আলাদা ট্রেইল রয়েছে।

কখন যাবেন: শীতকাল রেমা-কালেঙ্গা ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী সময়। বর্ষায় যাতায়াত কিছুটা কষ্টসাধ্য হতে পারে।

কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে শায়েস্তাগঞ্জ অথবা শ্রীমঙ্গল এসে সেখান থেকে সিএনজি বা জিপ ভাড়া করে রেমা-কালেঙ্গা যাওয়া যায়। হবিগঞ্জ শহর থেকে চুনারুঘাট হয়েও এখানে পৌঁছানো সম্ভব।

থাকা-খাওয়া: বনের ভেতরে বন বিভাগের বিশ্রামাগারে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে, তবে এর জন্য পূর্বানুমতির প্রয়োজন। এছাড়া শ্রীমঙ্গল বা হবিগঞ্জ শহরে রাত্রিযাপন করা যেতে পারে।


হবিগঞ্জের চা বাগান:
বৈকন্ঠপুর চা বাগান

হবিগঞ্জের বাহুবল, নবীগঞ্জ ও চুনারুঘাট উপজেলায় রয়েছে অসংখ্য চা বাগান। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ চা বাগানগুলোর মনোরম দৃশ্য যেকোনো ভ্রমণকারীকে মুগ্ধ করবে।

কী দেখবেন: বাহুবল উপজেলার বৃন্দাবন চা বাগান, নবীগঞ্জের ইমাম ও বাওয়ানী চা বাগান এবং চুনারুঘাটের চান্দপুর চা বাগান উল্লেখযোগ্য। চা গাছ থেকে পাতা তোলার দৃশ্য, চা প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং চা শ্রমিকদের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়।

কীভাবে যাবেন: হবিগঞ্জ শহর থেকে লোকাল বাস বা সিএনজিযোগে সহজেই এই চা বাগানগুলোতে পৌঁছানো যায়।

ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পীঠস্থান

 বিতঙ্গল আখড়া:

হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় অবস্থিত বিতঙ্গল আখড়া বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক পবিত্র তীর্থস্থান। হাওরের মধ্যবর্তী এক মনোরম পরিবেশে ষোড়শ শতকে রামকৃষ্ণ গোস্বামী এটি প্রতিষ্ঠা করেন।

কী দেখবেন: মধ্যযুগীয় স্থাপত্যশৈলীর আদলে নির্মিত এই আখড়ায় ১২০ জন বৈষ্ণবের থাকার জন্য ১২০টি কক্ষ রয়েছে। এখানকার ২৫ মণ ওজনের শ্বেতপাথরের চৌকি, পিতলের সিংহাসন ও প্রাচীন রথ পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে।

কখন যাবেন: বর্ষাকালে হাওরের পানিতে যখন চারপাশ থৈ থৈ করে, তখন নৌকায় করে আখড়ায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা এককথায় অসাধারণ। তবে বছরের যেকোনো সময়ই যাওয়া যায়।

কীভাবে যাবেন: হবিগঞ্জ শহর থেকে বানিয়াচং গিয়ে সেখান থেকে বর্ষাকালে নৌকা এবং শুকনা মৌসুমে জিপ বা মোটরসাইকেলে সুজাতপুর গিয়ে সেখান থেকে নৌকায় বা পায়ে হেঁটে আখড়ায় পৌঁছাতে হয়।

 শংকরপাশা শাহী মসজিদ:

হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় অবস্থিত শংকরপাশা শাহী মসজিদটি সুলতানি আমলের এক অনন্য স্থাপত্যকীর্তি। ১৪৯৩ সালে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে এটি নির্মিত হয়।

কী দেখবেন: পোড়ামাটির ফলক ও অসাধারণ কারুকার্যখচিত এই মসজিদে চারটি গম্বুজ রয়েছে। এর স্থাপত্যশৈলী তৎকালীন মুসলিম ঐতিহ্যের পরিচায়ক।

কীভাবে যাবেন: হবিগঞ্জ শহর থেকে অটোরিকশা বা সিএনজিযোগে সহজেই এই ঐতিহাসিক মসজিদে পৌঁছানো যায়।

আধুনিক বিনোদন ও অবকাশ যাপন

দ্যা প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট:

যারা প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে বিলাসবহুল পরিবেশে অবকাশ যাপন করতে চান, তাদের জন্য বাহুবল উপজেলায় অবস্থিত "দ্যা প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট" একটি আদর্শ জায়গা। প্রায় ১৫০ একর জায়গা জুড়ে পাহাড় ও সবুজের সমারোহে এই রিসোর্টটি নির্মিত।

বৈশিষ্ট্য: এখানে রয়েছে আধুনিক সকল সুযোগ-সুবিধাসহ ভিলা ও হোটেল কক্ষ, একাধিক রেস্তোরাঁ, সুইমিং পুল, সিনেপ্লেক্স এবং বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার ব্যবস্থা।

প্রবেশ: এখানে থাকতে বা ঘুরতে হলে আগে থেকে বুকিং করা আবশ্যক।

ভ্রমণ নির্দেশিকা

যাতায়াত: ঢাকা থেকে সড়ক ও রেলপথে সহজেই হবিগঞ্জ যাওয়া যায়। ঢাকার সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে হবিগঞ্জগামী বিভিন্ন বাস চলাচল করে। ট্রেনে যেতে চাইলে শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে নামতে হবে।

থাকা-খাওয়া: হবিগঞ্জ শহরে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। এছাড়া সাতছড়ি ও রেমা-কালেঙ্গার কাছে সরকারি বন বিশ্রামাগার এবং বাহুবলে বিলাসবহুল রিসোর্ট রয়েছে। হবিগঞ্জের স্থানীয় খাবারের স্বাদ নিতে শহরের রেস্তোরাঁগুলোতে ঢুঁ মারতে পারেন।

পরামর্শ:

o প্রাকৃতিক বনে ভ্রমণের সময় আরামদায়ক পোশাক ও জুতা পরুন।

o মশা তাড়ানোর স্প্রে ও প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম সঙ্গে রাখুন।

o পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন।

o স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন।

হবিগঞ্জের এই পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভ্রমণপিপাসুদের জন্য নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা বয়ে আনবে। তাই সুযোগ  পেলে ঘুরে আসুন প্রকৃতি ও ইতিহাসের এই অপূর্ব মিলনস্থল থেকে।

https://tiplolasker.blogspot.com/2017/08/blog-post_6.html



Tuesday, June 24, 2025

🌟 আয়াতুল কুরসি: কুরআনের রাজসিংহাসন

আয়াতুল কুরসি—পবিত্র কুরআনের সবচেয়ে মর্যাদাবান আয়াতগুলোর একটি। এটি সূরা আল-বাকারার ২৫৫ নম্বর আয়াত। একে শুধু একটি আয়াত বললে কমই বলা হবে, বরং বলা যায়, এটি ইসলামের আকীদা, আল্লাহর একত্ববাদের গৌরবগাথা এবং মুসলিম জীবনের নিরাপত্তার কবচ।







 ✨ আয়াতুল কুরসির উচ্চারণ, অর্থ ও তাৎপর্য বাংলা উচ্চারণ: 

আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুওয়াল হাইয়্যুল কাইয়ুম। লা তা খুজুহু সিনাতু ওয়ালা নাউম। লাহু মা ফিস সামা ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ। মান জাল্লাজি ইয়াশ-ফাউ ইনদাহু ইল্লা বি-ইজনিহি, ইয়ালামু মা বাইনা আইদীহিম ওয়ামা খলফাহুম, ওয়ালা ইউহিতুনা বিশাই-ইম মিন ইল-মিহি ইল্লা বিমা শাআ, ওয়াসিয়া কুরসিইউহুস সামাওয়াতি ওয়ালআরদ, ওয়ালা ইয়াউদুহু হিফজুহুমা ওয়াহুয়াল আলিইয়ুল আজীম। বাংলা অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সৃষ্টিকে ধারণকারী। তাঁকে তন্দ্রা বা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, সবই তাঁর। তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ সুপারিশ করতে পারে না। তিনি জানেন দৃষ্টিগোচর ও অদৃশ্য সবকিছু। তাঁর জ্ঞানের বাইরে কেউ কিছু জানে না, যতটুকু তিনি প্রকাশ করেন, ততটুকুই। তাঁর কুরসি আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টন করে আছে, আর এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ তাঁর জন্য কঠিন নয়। তিনি মহান ও সর্বোচ্চ। 

 🧠 আয়াতের গঠন ও অলৌকিক মিল আয়াতুল কুরসি পড়লে বোঝা যায়, এটি একটি নিখুঁত কাঠামোর মধ্যে সাজানো। এতে মোট ৯টি বাক্য, যা একে অপরের সঙ্গে বৈচিত্র্যময় অথচ গভীর অর্থে সংযুক্ত: • প্রথম ও নবম বাক্য আল্লাহর একত্ব ও মহত্ত্ব নিয়ে (আল্লাহ ছাড়া উপাস্য নেই → তিনিই সর্বোচ্চ এবং মহান) • দ্বিতীয় ও অষ্টম বাক্য রক্ষাকর্তা আল্লাহর নিদ্রাহীন সত্তা ও সৃষ্টি ধারণ করার ক্ষমতা নিয়ে • তৃতীয় ও সপ্তম বাক্য আসমান-জমিনের মালিকানা ও সেগুলোর পরিবেষ্টন • চতুর্থ ও ষষ্ঠ বাক্য আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কিছু করতে পারে না এবং তাঁর জ্ঞানের গভীরতা এইসব মিলের মাঝে দাঁড়িয়ে পঞ্চম বাক্যটি যেন আয়াতটির হৃদয়: “দৃষ্টির সামনে কিংবা পেছনে যা কিছু রয়েছে, সবই তিনি জানেন।” আল্লাহর সর্বজ্ঞ সত্তাকে এই বাক্যটি অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে কেন্দ্রস্থ করে। 

 💎 ফজিলত:

 জান্নাতের দ্বার উন্মুক্তঃ হজরত আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন:“যে ব্যক্তি প্রতিটি ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পড়ে, তার জান্নাতে প্রবেশ করতে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই বাধা হতে পারবে না।” (নাসাঈ: ৯৯৫) অর্থাৎ, একজন মুমিন যদি আন্তরিকভাবে এই আয়াতটি পড়েন, তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে যায়। শুধু মৃত্যুই সেই শেষ প্রহর যেটি তার জান্নাত-যাত্রার অন্তরায়। 

🛡️ আয়াতুল কুরসি ও রাত্রিকালীন নিরাপত্তা সহিহ বুখারির (হাদিস ২৩১১) এক আশ্চর্যজনক হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) শয়তানের ছদ্মবেশে আগত এক চোরের মুখ থেকে জেনেছিলেন:“ঘুমাতে যাওয়ার আগে আয়াতুল কুরসি পাঠ করলে আল্লাহ একজন পাহারাদার নিযুক্ত করবেন, এবং সকাল পর্যন্ত কোনো শয়তান তোমার কাছে আসতে পারবে না।” পরবর্তীতে রাসুল (সাঃ) আবু হুরায়রাকে বলেন:“সে চরম মিথ্যাবাদী, কিন্তু এই বিষয়ে সে সত্য বলেছে।” 

📿 আমাদের জীবনে আয়াতুল কুরসি • প্রতিদিন ফরজ নামাজ এর পর পাঠ করুন • রাতে ঘুমানোর আগে পড়ে শয়ন করুন • সন্তানদের মুখস্থ করাতে উৎসাহ দিন • ঘরে ঢোকার সময়, বের হওয়ার সময় এবং ভয়ের সময়ে এই আয়াত পাঠ করুন। 

 📌 আয়াতুল কুরসি শুধু কুরআনের একটি আয়াত নয়, বরং এটি একজন মুমিনের হৃদয়ের শান্তি, আত্মার প্রতিরক্ষা এবং জীবনের সঙ্গী। প্রতিদিন নিয়মিত পাঠ করা, মনে রাখা এবং বুঝে আমল করাই হোক আমাদের ইবাদতের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই আয়াত আমাদের শেখায়—আল্লাহর জ্ঞান, ক্ষমতা ও করুণার সামনে আমরা কতটাই না ক্ষুদ্র, আর তিনিই আমাদের সবচেয়ে বড় আশ্রয়।

Saturday, May 24, 2025

সালাত: মনোযোগ বৃদ্ধির এক অনন্য প্রশিক্ষণ

AI দিয়ে তৈরী 
বর্তমান সময়ের যান্ত্রিক প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে মানুষের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হয়ে দাঁড়িয়েছে মনোযোগ ধরে রাখা চারদিকে প্রযুক্তির আধিক্য, স্মার্টফোনের অবিরাম নোটিফিকেশন, সোশ্যাল মিডিয়ার অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে আমাদের মন প্রায়শই বিচ্যুত, অস্থির এবং দিশেহারা হয়ে পড়ে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই সমস্যা আরও প্রকটভাবে দেখা যায়।

এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসেএমন অগোছালো মানসিক পরিবেশে একজন মানুষ কীভাবে নিজের মনোযোগ ধরে রাখবে? কিভাবে শান্ত, স্থির একাগ্র মানসিকতা গড়ে তুলবে?

একজন মুসলিমের জন্য এর একটি কার্যকর সহজ উপায় হলো নিয়মিত সালাত আদায়। সালাত শুধুমাত্র ইবাদতের একটি অংশ নয়, বরং এটি এক ধরণের আধ্যাত্মিক অনুশীলনযা মনোসংযোগ, মানসিক প্রশান্তি এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

 সালাত: একাগ্রতার প্রশিক্ষণ

সালাতের প্রতিটি ধাপতাকবীর, রুকু, সেজদা, তাশাহহুদ, দোয়ামানুষকে মনোযোগ ধরে রাখার শিক্ষা দেয়। যখন কোনো মুসলমান আল্লাহর সামনে দাঁড়ায়, তার দৃষ্টি থাকে সেজদার স্থানে, জিহ্বায় থাকে পবিত্র কুরআনের আয়াত, আর হৃদয় থাকে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্নতখন এই সময়টা হয়ে ওঠে চরম এক মাইন্ডফুলনেসের অনুশীলন

বর্তমানে মাইন্ডফুলনেস নামে পরিচিত একটি থেরাপি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বর্তমান মুহূর্তে সচেতনভাবে উপস্থিত থাকা। অথচ ইসলাম বহু আগেই তার অনুসারীদের জন্য প্রতিদিন পাঁচবার এই অনুশীলনের সুযোগ দিয়েছেযা হচ্ছে সালাত।

 সালাতের মাধ্যমে মনোযোগ বৃদ্ধির কিছু বৈজ্ঞানিক বাস্তব উপকারিতা:

. মানসিক প্রশান্তি:

সালাত মানুষের মনে প্রশান্তির এক প্রশ্রয় দেয়। যারা নিয়মিত নামাজ পড়েন, তারা স্বীকার করেন যে, কাজের ব্যস্ততার মাঝেও সালাত তাদের মনে স্বস্তি এনে দেয়, যা মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে।

. চাপ দুশ্চিন্তা হ্রাস:

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সালাত মানসিক চাপ কমায়। বিশেষ করে খুশু খুযু (একাগ্রতা বিনয়) সহকারে সালাত আদায়কারীদের মধ্যে দুশ্চিন্তার মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকে।

. ডিজিটাল ডিটক্স:

প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ প্রযুক্তি ব্যস্ততা থেকে সাময়িক মুক্তির সুযোগ করে দেয়। এটি যেন দিনে পাঁচবার নিজেকে রিসেট করার সময়, যা মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক।

. শৃঙ্খলা রুটিন:

সালাত সময়ানুবর্তিতার একটি শিক্ষণীয় মাধ্যম। সময়মতো সালাত আদায় একজন ব্যক্তিকে শৃঙ্খলিত জীবনধারায় অভ্যস্ত করে, যা মনোযোগের অন্যতম ভিত্তি।

. আত্মনিয়ন্ত্রণ আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি:

নিয়মিত সময়মতো নামাজ পড়ার অভ্যাস আত্মনিয়ন্ত্রণ গড়ে তোলে এবং ব্যক্তির মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে।

 আধ্যাত্মিকতার সাথে বাস্তব প্রশিক্ষণ

সালাত এমন এক মাধ্যম, যা একইসাথে আত্মাকে প্রশান্তি দেয় এবং মনকে প্রশিক্ষিত করে। কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে
নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীলতা মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে (সূরা আনকাবুত, আয়াত ৪৫)
এই বিরত থাকা শুধু খারাপ কাজ থেকে নয়, বরং এটি মনোযোগের বিচ্যুতি, অস্থিরতা এবং বিক্ষিপ্ত চিন্তা থেকেও রক্ষা করে।

আমেরিকান নিউরোসায়েন্টিস্ট অ্যান্ড্রু নিউবার্গ গবেষক মার্ক ওয়াল্ডম্যান তাঁদের বই How God Changes Your Brain- উল্লেখ করেছেন, প্রার্থনার সময় মানুষের মস্তিষ্কের prefrontal cortex সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়যা গভীর মনোযোগ আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

সালাত কেবল আখিরাতের পাথেয় নয়, এটি দুনিয়ার জীবনের জন্যও এক মহামূল্যবান উপহার। এটি একটি আত্মিক প্রশিক্ষণ, যা মনোযোগ, ধৈর্য, মানসিক স্থিতি শৃঙ্খলাবোধের মাধ্যমে একজন মানুষকে উন্নত করে তোলে।

যদি আমরা সালাতের খুশু খুযুর গভীরতা অনুধাবন করে সালাত আদায় করতে পারি, তবে শুধু ইবাদত নয়, বরং মনোযোগ বৃদ্ধি, মানসিক প্রশান্তি এবং সাফল্যময় জীবনের পথেও এটি এক অসাধারণ সহায়ক হয়ে উঠবে

 সুরা বাকারা'র শেষ দুই আয়াত এর ফজিলত ও আমল