ভালো থাকতে কে না চায়? তাই আমাদের আমাদের জানা উচিত কিভাবে ভালো থাকা যায়। এজন্য প্রয়োজন জানা প্রতিদিন কি কি করা উচিত?
এ বিষয়ে টমাস আলভা এডিসন বলেছিলেন, ”ভবিষ্যতের চিকিৎসক রোগীকে ওষুধ না দিয়ে তাকে শেখাবেন শরীরের যত্ন নেওয়া, সঠিক খাদ্য নির্বাচন,রোগের কারণ নির্ণয় ও তা প্রতিরোধের উপায়।”
শরীরের যত্ন, খাদ্যাভাস বিচার ও রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে আমরা এখনও যথেষ্ট সচেতন নই। এ বিষয়ে বিভিন্ন চিকিৎসক ও গবেষক সুস্থ থাকার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আসুন আমরা জেনে নেই আমরা কিভাবে সুস্থ থাকতে পারি।
ব্যায়ামঃ
১. উপযুক্ত ব্যায়াম ও খাদ্যাভ্যাস এবং প্রফুল্ল মনই হচ্ছে সুস্থ থাকার চাবিকাঠি। আসলে আমাদের জীবনে এত দুশ্চিন্তা বা টেনশন থাকে, আমরা হাসিখুশি থাকতে পারি না। অথচ কথায় আছে, ক্যান্সারে যত না কবর ভরেছে তার চেয়ে বেশি ভরেছে টেনশনে। সুতরাং ভালোভাবে বাঁচতে চাইলে মনকে প্রফুল্ল রাখতে হবে। এ জন্য ভালো চিন্তা ও ভালো কাজের কোনও বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে নিজেকে জড়াতে হবে কোনও না কোনও সৃজনশীল কাজের সঙ্গে।
২. চোট বেলা থেকেই ব্যায়াম শুরু করা উচিত। ব্যায়াম অনেক রকম, যেমন হাঁটা, সাঁতার কাটা ও দৌড়-ঝাঁপ ইত্যাদি ব্যায়াম, সাইকেল কিংবা অন্যান্য যন্ত্রপাতি চালিয়ে ও ভারি কিছু ওপরে তোলার মাধ্যমে ব্যায়াম, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মালিশের দ্বারা ব্যায়াম এবং দেহকে বিশেষ ভঙ্গিমায় স্থির রেখে যোগ ব্যায়াম। সব ব্যায়ামেই উপকার হয়। তবে বয়স, শারীরিক অবস্থানুযায়ী তা প্রয়োজন। পরিবেশগত সুবিধা, সময়ের সীমাবদ্ধতা ও মানসিক প্রবণতার কথা ভেবে ব্যায়াম বেছে নেওয়া ভালো। কিছু ব্যায়াম আছে যা একেবারে শয্যাশায়ী বা চলাফেরায় অক্ষম না হলে সবার পক্ষেই করা সম্ভব।
৩. প্রতিদিন ৪৫ মিনিট জোরে হাঁটুন। একবারে না পারলে কয়েকবারে। এতে দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নমনীয় থাকে ও মস্তিষ্কে প্রচুর অক্সিজেন প্রবেশ করায় দুশ্চিন্তা কমে। হাঁটায় মহিলাদের ঋতু বন্ধজনিত হাড়ক্ষয় এবং অন্যান্য জটিলতাও রোধ হয়।
৪. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়াচড়া এবং মালিশ করা ভালো ব্যায়াম। এতে রক্ত সঞ্চালন সহজ হওয়ায় চর্বি জমতে পারে না। এখানে দেহের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্থানে মালিশের উল্লেখ করা হল যার দ্বারা কাছের তো বটেই, দূরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও উপকৃত হয়।
ক. যখনই সম্ভব পুরো মাথা মালিশ করলে মাথায় ভালোভাবে রক্ত চলাচল করে বলে মগজ তথা স্নায়ুকেন্দ্র ভালো থাকে ও সহজে চুল পড়ে না কিংবা পাকে না।
খ. প্রতিদিন ১০ মিনিট হাত ঘুরিয়ে ভেজা কপাল মালিশ করলে শারীরিক বৃদ্ধিকারক পিটুইটারি গ্রন্থি সতেজ থাকে।
গ. কানের সামনে-পেছনে মালিশ করলে এবং কানের লতিসহ কান মোচড়ালে পাকস্থলি ভালো থাকে।
ঘ. নাকের ডগা হাতের তালু দিয়ে ঘোরালে কিডনি সবল থাকে।
ঙ. শরীর ও মনের যে কোনও চাপের প্রথম শিকার হচ্ছে ঘাড়। কাজেই ঘাড় মালিশ করলে এবং মাথা ওপর-নিচ ও চারপাশে হেলিয়ে ঘোরালে ঘাড় নমনীয় থাকে।
চ. চোয়ালের নিচে গলার দু’পাশে মালিশ করলে থাইরয়েড ও টনসিলগ্রন্থি ভালো থাকে।
ছ. কনুইয়ের জোড়ায় হালকা চাপ দিয়ে এবং কনুই ও কব্জির মাঝখানে স্বাভাবিকভাবে মালিশ করলে হাত খুব সচল থাকে।
জ. নাভির চারপাশে মালিশ করলে দুশ্চিন্তা কমে এবং চিৎ হয়ে শুয়ে এটি করলে সহজে আন্ত্রিক সমস্যা হয় না।
৫. শুয়ে পেটের ওপরে দু’হাত রেখে গভীরভাবে নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে পেট ফুলিয়ে মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ছাড়লে ফুসফুসের শক্তি বাড়ে এবং দিনে ২০ মিনিট এটি করলে ভালো ঘুম হয়।
৬. স্নায়ুতন্ত্রের এক বড় অংশ শেষ হয়েছে হাতের তালুতে ও পায়ের তলায়। এ জন্য হাততালি দিলে চোখের ছানি দূর হয়, উচ্চরক্তচাপ কমে এবং শ্রবণশক্তি বাড়ে। পায়ের তলা কর্কশ কোনও কিছু, যেমন ধুন্দুলের ছোবড়া কিংবা পলাস্টিকের ব্রাশ দিয়ে দিনে মোট ২০ মিনিট ঘষলে দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই উদ্দীপ্ত হয়, সতেজ থাকে এবং রোগাক্রান্ত হলেও ধীরে ধীরে সুস্থ হয়। বিশেষত অনিদ্রা, হূদরোগ ও স্ট্রোক প্রতিরোধে এবং মহিলাদের গর্ভাবস্থায় খুব উপকার পাওয়া যায়। পায়ের তলা ঘষার পর আঙ্গুলগুলো ওপর নিচ করে টানুন।
৭. মুখ ধোয়ার সময়ে চোখে ২৫ বার পানির ঝাপটা দিন। নাক দিয়ে পানি যতটা পারা যায় টানুন ও ছাড়-ন। এতে সহজে সর্দি-কাশি হবে না। এটি মাথাব্যথা, সাইনুসাইটিস ও মাইগ্রেইনে খুব উপকারী।
৮. আমাদের উপমহাদেশে উদ্ভাবিত যোগ ব্যায়াম আজ সারা পৃথিবীতে সমাদৃত, অথচ আমরা অনেকে এ বিষয়ে অজ্ঞ। যোগ ব্যায়ামের ওপরে সুলিখিত অনেক বই আজকাল পাওয়া যায়। এসব পড়ে এবং সম্ভব হলে কোনও বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে সঠিক ধারণা পেতে পারেন। এ ব্যায়ামের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিভিন্ন দেহভঙ্গিমা, যাকে আসন বলা হয়। এক-এক আসনে দেহে এক-একভাবে চাপ পড়ে যা দেহের এক-এক অংশের উপকার সাধন করে। এসব আসনে কিছুক্ষণ থাকার পর একটি বিশেষ আসনে বিশ্রাম নিতে হয়, যাকে বলে শবাসন।
৯. মনকে চিন্তামুক্ত রেখে বালিশ ছাড়া চিৎ হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে শবাসন করতে হয়। সকালে ঘুম ভাঙলে লাফিয়ে বিছানা থেকে না উঠে কিছুক্ষণ শবাসন করুন। এতে শক্তি ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। প্রতিদিন আধঘণ্টা শবাসন করলে মেরুদন্ড ভালো থাকে, অনেক পরিশ্রম ও মানসিক চাপ সহ্য করা যায় এবং দেহের যে কোনও ব্যথা ও লুকানো সমস্যা দূর হয়। উল্লেখ, মেরুদন্ড ও পাঁজরের হাড়ের মজ্জা থেকে বেশির ভাগ রক্ত উৎপন্ন হয়।
খাবার ও খাদ্যঃ
খাদ্যবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘আপনি যা খান আপনি তা-ই।’ আজকাল যে অনেক জটিল রোগ আমাদের পিছু নিয়েছে তার একটা বড় কারণ হল কৃত্রিম সার ও কীটনাশক বিষের ব্যবহার। এ যুগে খাদ্যের আদি বিশুদ্ধতা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তার ওপরে রয়েছে নানা রকম প্রক্রিয়াজাত, ভেজাল মিশ্রিত ও রাসায়নিক উপায়ে সংরক্ষিত খাদ্য যা কোনভাবেই খাঁটি ও টাটকা খাবারের সমকক্ষ হতে পারে না। ফ্রিজে দীর্ঘদিন রাখা খাদ্যও ক্ষতিকর। অথচ সুস্থ জীবকোষের জন্য বিশুদ্ধ রক্ত দরকার যা শুধু খাঁটি ও টাটকা খাবার থেকেই তৈরি হয়।
✬ খাদ্যের একটি গুণগত উপাদান হচ্ছে আঁশ যা অন্ত্রনালী পরিষ্কার রাখে বলে ক্যান্সার প্রতিরোধ সহজ হয়। গমের আটায় আঁশ আছে, ময়দায় নেই। ময়দা একটি প্রক্রিয়াজাত মৃত খাদ্য যা কোষ্ঠকাঠিন্য ও ক্যান্সারের সহায়ক। এ রকম আরেকটি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য হচ্ছে চিনি যা অনেক মারাত্মক রোগের কারণ চিনি রক্তের ঘনত্ব বাড়ায় এবং হাড় ক্ষয় করে। সুতরাং ময়দা ও চিনির তৈরি খাদ্য পুরোপুরি বর্জন করা ভালো। সেই সঙ্গে তেল, লবণ ও মশলা নামমাত্র পরিমাণে ব্যবহার করা উচিত।
✬ প্রতিদিন আহারের শতকরা ৪০ ভাগ শ্বেতসার, ১৫ ভাগ আমিষ এবং ৪৫ ভাগ শাকসবজি ও ফল দিয়ে পূরণ করুন। তবে শ্বেতসার জাতীয় খাদ্য যথা ভাত, রুটি, আলু ইত্যাদির সঙ্গে ফল খাবেন না; অন্তত আধ ঘণ্টা পার্থক্য রেখে খাবেন। শ্বেতসারের সঙ্গে আমিষ জাতীয় খাদ্য যথা মাছ, মাংস, ডিম খাওয়াও ভালো নয়। সবজিই হচ্ছে একমাত্র খাদ্য যা আমিষ কিংবা শ্বেতসার- উভয়ের সঙ্গেই খাওয়া যায়। দিনে অন্তত আধা কেজি সবজি খান। সকাল শুরু করুন বেশ খানিকটা কাঁচা পেঁপে ও ফল খেয়ে। এতে যকৃৎ ভালো থাকবে। অংকুরিত গম, ছোলা, মুগ, সিমবীচি প্রভৃতি এবং আটা ও যবের তৈরি খাদ্য নাশতা হিসেবে ভালো। শাক, শিম ও কপি রাতের বেলায় পেটে বায়ু তৈরি করে বলে এগুলো দিনে খাওয়া উচিত।
✬ আমিষের উৎস হিসেবে ডাল চমৎকার। বিশেষত মুগ, মসুর ও মাষকলাই। তা ছাড়া ছোলার ডাল ও অংকুরিত ছোলা সব বয়সের মানবদেহে আমিষের ঘাটতি পূরণ করে এবং বহুমূত্রে ভালো। সেদ্ধ সয়াবিন আছে এমন উপাদান যা বহুমূত্রে এবং পুরুষের প্রোস্টেটগ্রন্থি ও নারীর জরায়ু রক্ষায় উপকারী। প্রাণীজ আমিষের জন্য মাছ, মুরগির মাংস ও ডিমের শ্বেতাংশ ভালো। লাল মাংস অর্থাৎ গরু-খাসির মাংস উপাদেয় হলেও ক্ষতিকর চর্বি থাকায় তা অনেক ভয়াবহ রোগের উৎস।
✬ সকালে দাঁত মাজার আগে ৬৫০ গ্রাম কুসুম গরম পানি পান করার পর ৪৫ মিনিট পানাহার বন্ধ রাখুন। এতে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয় ও অম্লতাসহ বহু জটিল রোগ সারে। দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন। মেয়েরা কখনও দাঁড়িয়ে পানি পান করবেন না, এতে জরায়ুর ক্ষতি হয়। স্বাস্থ্যকর পানীয় হিসেবে দুধ চিনি ছাড়া হালকা চা ভালো। ডাবের পানিও ভালো, তবে দিনে একটির বেশি নয়। গরমে প্রাণ জুড়াতে লেবুজলে মধু বা অল্প গুড় মিশিয়ে পান করুন এবং কোলাজাতীয় যাবতীয় কোমল পানীয় ধেকে দূরে থাকুন। কারণ সে ফ মুনাফালোভী ফর্মুলায় বাজারজাত এবং ঝলমলে বিজ্ঞাপনে দেখানো সুদৃশ্য বোতলে ভরা, প্রচুর চিনিগোলা ও সুস্বাদু এসব শরবত ডায়াবেটিসসহ অনেক বড় বড় রোগের কারণ। এগুলোর সঙ্গে এখন ফাস্ট ফুড যোগ হওয়ায় ফাস্ট ডেথ বা দ্রুত মৃত্যুর ভিত্তি তৈরি হয়েছে।
✬ খাওয়ার পরিমাণ এবং সময়ও গুরুত্বপূর্ণ। কখনও পেট পুরে খাবেন না। প্রতিদিন একই সময়ে খাওয়া উচিত। রাতের খাওয়া আটটার মধ্যে চুকিয়ে ফেলা ভালো। কারণ বিকাল থেকে হজম শক্তি কমতে থাকে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কিছু খাবারঃ
দৈনিক কিছু পরিমাণ টক দই এবং সকালে পানি মিশিয়ে তৈরি করে ছেঁকে নেয়া এক গ্লাস সবুজ শাকের রস (বাঁধাকপি, কলমী, থানকুনি, লেটুস, তেলাকুচা, পাথরকুচি ইত্যাদি) সম্ভব হলে মধু, শুকনো আদা ও ত্রিফলা এবং শুকনো আমলকী, হরীতকী ও বহেরার গুঁড়া মিশিয়ে পান করলে শরীর সতেজ থাকে। একইভাবে পান করা ভালো কাঁচা পেঁপে, গাজর ও লাউয়ের মতো সবজি এবং কামরাঙ্গা ও জাম্বুরার মতো ফলের রস। কাঁচা বেল ফালি করে রোদে শুকিয়ে তৈরি বেল শুঁটকি ভিজিয়ে বা সেদ্ধ করে পানিসহ নিয়মিত খেলে পেটের অনেক পুরনো অসুখ, যেমন অজীর্ণ ও আমাশয় সেরে যায়। কলমী শাক ত্বক ভালো রাখে ও ঘা সারায়। কচু শাক রক্ত তৈরি ও পরিষ্কার করে। থানকুনি পাতা পেট, চোখ ও চুল ভালো রাখে। পুদিনা পাতা ফুসফুস, হূৎপিন্ড ও পেট ভালো রাখে। আদা বাত ও মাথাব্যথা কমায় এবং হজম শক্তি বাড়ায়। আমলকী ভিটামিন ‘সি’-এর সবচেয়ে ভালো উৎস। তিল তারুণ্য ধরে রাখে। কাঁচা হলুদ রক্ত পরিষ্কার এবং ঠান্ডা প্রতিরোধক। কালজিরাকে প্রাচীন কাল থেকেই বলা হয় হাজার রোগের ওষুধ। স্পিরুলিনা শরীরের ক্ষয় পূরণ করে এবং উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিসসহ অনেক রোগে উপকারী। রসুনসেদ্ধ পানি সর্দি-কাশি প্রতিরোধ কর।
মুখের যত্ন ও ঘুমঃ
✬ মুখের অপরিচ্ছন্নতা থেকে অনেক রোগ হয়। তাই রাতে শোয়ার আগে অবশ্যই দাঁত মাজুন
✬ মোটামুটি শক্ত বিছানায় ঘুমানোর আগে শবাসন করতে করতে মনের যত দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলুন।
📝 ইন্টারনেট হতে সংগৃহীত