Sunday, August 6, 2017

হাওরের ফসল হারানো ৫ গ্রামের মানুষের অভাবে বিরুদ্ধে লড়াই জয়ী হয়েছে‘গুই-রুঙ্গা’তৈরী করে।



কর্মমূখী উদ্যোগ এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরের আঙ্গারুলি হাওর পাড়ের ৫ টি গ্রামের প্রায় সাড়ে চার’শ পরিবার ফসল ডুবির কষ্ট ভুলে গেছে। এই পরিবারগুলোর ১০ বছর বয়সি শিশু
থেকে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা সকলেই টেংরা ও ইছা মাছ ধরার যন্ত্র গুই (ছাই) ও রুঙ্গা’র কারিগর। গ্রামগুলোর প্রায় তিন হাজার মানুষের একেক জনের প্রতিদিনের আয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা।
পরিবারগুলো এবার এক ছটাক ধান ঘরে তুলতে না পারলেও কারো মুখে কষ্টের চিহ্ন নেই। গ্রামের একাধিক পুরুষ-মহিলা বললেন,‘আমাদের কোথাও কাজ খুঁজতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গ্রামের প্রত্যেকটি
হাতেই কাজে রয়েছে।’
বিশ্বম্ভরপুরের ফতেহপুর ও দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়নের ব্রজনাথপুরের ১১০ পরিবার, গোপালপুরের ১৫০ পরিবার, চান্দারগাঁওয়ের ১০০ পরিবার, লক্ষীপুরের ৫০ পরিবার এবং রাজনগরের ২৫ পরিবারের অবুঝ
 শিশু ছাড়া সকলেই রুঙ্গা ও গুইয়ের কারিগর। রুঙ্গা দিয়ে ইছা মাছ এবং গুই দিয়ে টেংরা মাছ ধরা হয়। এক সময় এই গ্রামগুলোর মানুষ কৃষি কাজ এবং কেউ কেউ বর্ষায় মাছ ধরে বিক্রি করতেন। প্রায় ২০ বছর
আগে এরা পেশা বদল করে হেমন্তে কৃষক এবং বর্ষায় গুই বানিয়ে বিক্রি’র পেশায় যুক্ত হন।
গ্রামের আরাধন বিশ্বাস প্রায় ২০-২৫ বছর আগে প্রথম গুই বানিয়ে বিক্রি শুরু করেন। এরপর একে একে বাড়তে থাকে কারিগর। এখন এই ৫ গ্রামে কে এই কাজ করে না, খুঁজে বের করতে হবে। এই গ্রামে
 বিয়ে হয়ে আসলে ২-৩ মাসের মধ্যেই কাজ আয়ত্বে নেয় নতুন বৌ-রা। আবার অনেকে বিয়ে হয়ে অন্য গ্রামে গিয়েও নতুন  শ্বশুর বাড়ির পরিবারের অন্যদের এই কাজ শেখায়।
এই অঞ্চলের কারিগরদের প্লাস্টিকের রুঙ্গা বানানোর কাজ শেখান ১০ বছর আগে বিয়ে হয়ে আসা কুমিল্লার এক গৃহবধূ । ব্রজনাথপুরে এই ধরনের প্রথম রুঙ্গা বানান ৪৫ বছর বয়সি অর্জুুন বিশ্বাস।
ব্রজনাথপুরের ৫০ বছর বয়সি- হরে কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন,‘প্রথমে আমার দাদা আরাধন বিশ্বাস এই গ্রামে গুইয়ের কাজ শুরু করেন। 
এখন ৮-১০ বছর বয়সি স্কুল পড়–য়া শিশু থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থী, ঘরে থাকা ছেলে-মেয়ে সকলেই গুই-রুঙ্গা’র কারিগর।’
ব্রজনাথপুরের মিনা রানী বিশ্বাস বলেন,‘আমি অন্য স্থান থেকে বউ হয়ে এসে ৬ মাসের মধ্যেই গুই ও রুঙ্গা বানানোর কাজ শিখেছি। আমাদের গ্রামের মেয়ে ভাগ্যবতী বিশ্বাসের (২৬) বিয়ে হয়েছে সিলেটের
দাউদকান্দিতে। সে ওখানে তার নিজের পরিবারসহ কয়েক পরিবারকে গুই-রুঙ্গা বানানো শিখিয়েছে, এরাও এখন পরিবার শুদ্ধ সকলে এই কাজ করেন।’ মিনা বললেন,‘আমাদের সংসারের প্রায় আড়াই হাল
জমি এবার পানিতে ডুবেছে, ঘটের নিচে দেবার ধানও নেই। ১৮ জনের পরিবার, যদি আমরা এই কাজ না জানতাম তাহলে না খেয়ে মরতে হতো। আমাদের পরিবারের সকলেই রাত ১১ টা পর্যন্ত এখন গুই-রুঙ্গা
বানানোর কাজ করি। ধান চলে যাওয়ায় আমাদের কিনে খেতে হচ্ছে, কিন্তু কর্ম করতে পারায় আমাদেরকে অভাবী বলা যাবে না। ধান হলে অবশ্য ধনি-ই থাকতাম।’
ব্রজনাথপুরের মোহন লাল বিশ্বাস বলেন,‘এক কুড়ি রুঙ্গা বানাতে চার’শ টাকা খরচ হয়। বিক্রি হয় ১৫-১৬’শ টাকা। জনে দিনে ৭ থেকে ১০ টি বানাতে পারে। গুই এক কুড়ি বানাতে খরচ হয় সাড়ে চার’শ টাকা,
 বিক্রি হয় ১৬-১৭’শ টাকা।’ তিনি জানান, গুই-রুঙ্গা বানাতে বিশ্বম্ভরপুর বাজারে বাঁশ আনতে গিয়ে বাজারের ইজারাদার কর্তৃক হয়রানির শিকার হন তারা।
গ্রামের গোবিন্দ বিশ্বাস বলেন,‘গ্রামের বড় পরিবার থেকে ছোট পরিবার, প্রায় সকলেই এনজিওদের কাছে ঋণগ্রস্ত। বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের কাছে। যদি সমাজসেবা বা কৃষি ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে কম সুদে
 ঋণ পাওয়া যেতো, তাহলে ভালো হতো।’
যমুনা বিশ্বাস বলেন, ‘গুই-রুঙ্গা বিক্রি করতে ক্রেতা’র কোন অভাব হয় না। অনেক পাইকার বাড়ি থেকে এসে কিনে নেয় এবং বিভিন্ন বাজারে গিয়ে বিক্রি করে। আবার আমাদের লোকজনও অনেক সময়
সুনামগঞ্জে নিয়ে বিক্রি করেন। এবার ক্রেতা বেড়েছে। এবার জেলেরা ছাড়াও অনেক নতুন নতুন ক্রেতা এসে এগুলো কিনে নিচ্ছেন। যারা এর আগে কখনোই এসব যন্ত্র দিয়ে মাছ ধরেন নি, এরাও আসছেন
এসব যন্ত্র কিনে হাওরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে। এজন্য অন্য বছরের চেয়ে এবার এলাকার সকল কারিগরদেরই ব্যবসা ভালো।’
লেখাটি বিশ্বম্ভরপুর প্রেসক্লাব সভাপতি স্বপন কুমার বর্মন এর নিকট হতে সংগৃহীত


হাওর

0 comments:

Post a Comment